দশমহাবিদ্যার প্রথম হল কালী। মহাভাগবতের মতে মহাকালী হচ্ছেন মুখ্য (প্রধান) এবং তার উগ্র ও সৌম্য দুই রূপের অন্তবতী অনেক রূপ ধারণকারিণী হল দশমহাবিদ্যা। বিদ্যাপতি ভগবান মহাদেবের শক্তি এই দশমহাবিদ্যা অনন্ত সিদ্ধি প্রদানকারিণী। দার্শনিক দিক থেকেও কালতত্ত্বের প্রাধান্যই সবার উপরে। এইজন্যই বা কালীই সমস্ত বিদ্যার আদি অর্থাৎ তার বিদ্যাময় বিভূতি সকলই মহাবিদ্যা। মনে হয় মহাকালের প্রিয়তমা কালীই নিজের দক্ষিণ ও বাম রূপসমূহে দশমহাবিদ্যা নামে বিখ্যাত। বৃহন্নলাতন্ত্রে বলা আছে যে রক্ত ও কৃষ্ণভেদে কালীই দুই রূপে অধিষ্ঠিতা কৃষ্ণার নাম “দক্ষিণা’ এবং রক্তবর্ণার নাম সুন্দরী’ ৮০–
কালী কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে যে একদা হিমালয়ে অবস্থিত মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে গিয়ে দেবতারা মহামায়ার স্তুতি করেন। স্তুতিতে প্ৰসন্না হয়ে মতঙ্গের স্ত্রীর রূপ ধারণ করে ভগবতী দেবতাদের দর্শন দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন—তোমরা কার স্তব করছ? সেই সময় দেবীর শরীর থেকে কালো পাহাড়ের মত বর্ণযুক্তা আরো এক দিব্য নারী প্রকট হন। সেই মহাতেজস্বিনী নিজেই দেবতাদের তরফ থেকে প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে ‘এরা আমারই স্তব করছে।” সেই নারী কাজলের মত কৃষ্ণবর্ণা ছিলেন, সেইজন্য তাঁর নাম হয় “কালী’ ।
শ্ৰীশ্ৰীচণ্ডী অনুসারে একদা শুম্ভ ও নিশুম্ভের অত্যাচারে ক্লিষ্ট হয়ে দেবতারা হিমালয়ে গিয়ে দেবীসূক্ত’ দিয়ে দেবীর বন্দনা করেন, তখন গৌরীর দেহ থেকে কৌশিকী আবির্ভূত হন। কৌশিকী গৌরীদেহ থেকে আলাদা হওয়ামাত্রই অন্যা পার্বতীর স্বরূপ কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যায় এবং তখন তিনি “কালী” নামে বিখ্যাত হন । কালী নীলবৰ্ণ হওয়ায় তিনি তারা নামেও পরিচিতা । নারদ-পঞ্চরাত্রের মতে একদা কালীর মনে হল যে তিনি আবার গৌরী হবেন । এই চিন্তা করে তিনি অন্তর্ধান করেন। মহাদেব নরদের কাছে কালীর সন্ধান জিজ্ঞাসা করেন। নারদ সুমেরু পর্বতের উত্তরে দেবীর প্রত্যক্ষ উপস্থিতির সংবাদ দেন। শিবের অনুরোধে নারদ সেখানে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেবীর কাছে শিবের সাথে বিবাহের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব শুনে দেবী অত্যন্ত কুপিতা হন এবং তার দেহ থেকে এক অন্য ষোড়শী
| বিগ্ৰহ প্রকট হন এবং সেই দেহ থেকে এক ছায়া বিগ্রহ ত্রিপুরেশ্বরী আর্বিভূত হন।
কালীর পূজাপদ্ধতিতে সম্প্রদায়গত পার্থক্য আছে। সাধারণত ৪ কালীর দুটি রূপের উপাসনার পদ্ধতি প্রচলিত আছে। ভববন্ধন মােচনের উদ্দেশ্যে কালীর উপাসনাই সর্বোৎকৃষ্ট বলা হয়। শক্তিসাধনায় দুই পীঠের মধ্যে শ্যামপীঠেই কালীর উপাসনা করা উচিত। ভক্তিমার্গে তো যে কোনও রূপেই সেই মহামায়ার উপাসনা ফলপ্রসূ হয়। কিন্তু সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে তাঁর উপাসনা বীরভাবে করা হয়। সাধনার ফলে অহংবােধ, মমত্বুদ্ধি ও ভেদাভেদজ্ঞান শেষ হয়ে যখন সাধকের পূর্ণ শিশুভাবের
| জাগরণ হয় তখন কালীর শ্ৰীবিগ্ৰহ সাধকের সামনে প্রকট হয়। সেই সময় ভাগবতী কালীর রূপ
অবর্ণনীয়। কাজলের পাহাড়ের মত দিগ্ধসনা, এলোকেশী, শবারূঢ়া, মুণ্ডমালিনী ভগবতী কালীর প্রত্যক্ষ | দর্শন পেয়ে সাধক কৃতকৃত্য হন। তান্ত্রিকমতে যদিও কালীর উপাসনা দীক্ষাগম্য (অর্থাৎ কেবল দীক্ষিতেরই অধিকার), তবুও অনন্য শরণাগতি দ্বারা তাঁর কৃপা যে কেউই লাভ করতে পারে।